আকবর এবং আওরঙ্গজেবঃ দুটি শাসনের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা
লেখক: রজীউদ্দীন অকীল
অনুবাদক: মিনহাজ আমান
মোঘল সাম্রাজ্যের জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) এবং আওরঙ্গজেব আলমগীর (১৬৫৮-১৭০৭) রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একে অপরের উল্টো নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যাই হোক, আমরা তাদের সম্পর্কে যা জানি তার সবই আজকের আধুনিক আদর্শিক অবস্থান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং গুরুত্বপূর্ন নানা রাজনৈতিক ঘটনার পাঠ দ্বারা অনুপ্রাণিত। হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের কাছে আওরঙ্গজেব কতৃক ১৬৭৯ সালে জিজিয়ার মত বৈষম্যমূলক ট্যাক্সের পূনঃআরোপ মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত আছে। এহেন ধর্মীয় গোঁড়ামি সেখানকার সাধারণত রাজপুত, মারাঠি এবং হিন্দুদেরকে সমাজবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে যা উক্ত সাম্রাজ্যের ঐক্যকে নষ্ট করায় ত্বরান্বিত করেছে। অন্যদিকে মুসলিম বিচ্ছিন্নবাদীদের কাছে, সাম্রাজ্যের প্রতি হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান বিরোধীতার ফলেই আওরঙ্গজেবের কাছে মুসলিমদের টানা ছাড়া আর কোন রাস্তা ছিল না। অপরদিকে সেক্যুলাররাও তাদের পুরানো স্টেরিওটাইপগুলোকেই সাধারণ কিছু বাইনারি ব্যবহার করে বলছে, আকবর ছিল মহান এবং সেক্যুলার অন্যদিকে আওরঙ্গজেব খারাপ এবং সংকীর্নমনা। ফলে এসবের ব্যাপারে ভাবার আগে আমাদের নিজেদের আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নানা প্রস্তাবের উর্ধ্বে আসতে হবে। আর এসবের বদলে এই দুই সম্রাটের ধর্মীয় নীতিগুলোকে তাদের তখনকার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে।
আকবরের এমন পরিচয় একদিনে গড়ে উঠেনি। তার শাসনের প্রথম দুই দশক অতটা আশা জাগানিয়া ছিল না। তিনি তার শত্রুদের বিরুদ্ধে ছিলেন মারাত্মক বিধ্বংসী এবং তিনি তার নানা রাজনৈতিক পদক্ষেপকে জায়েজ করতে ধর্মীয় ইস্যুও ব্যবহার করতেন। মানুষ আসলে চেনে যায় তার শত্রুদের দিয়ে। এক্ষেত্রে আকবরের বিরুদ্ধে মহারানা প্রতাপের লড়াইয়ের কথা চলে আসতে পারে। যদিও মহারানা প্রতাপ যুদ্ধবাজ রাজপুত্র হিসাবে হিন্দু ইতিহাসে ব্যাপক জনপ্রিয় তবে শিবাজি এবং তার দুর্দান্ত মারাঠীদের তুলনায় কিছুইনা, আর এদের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল আওরঙ্গজেবকে।
আসলে আকবর যদি তার সময়ের ঠিক শতবছর পরে শাসনক্ষমতায় আসতেন, তখন তিনিও আওরঙ্গজেবের সাথে ঘটা সমস্যাগুলোর মুখোমুখী হতেন। দক্ষিন ভারতের এমন বিরাট বিরাট বিরোধীদের(শিয়া সুলতান, মারাঠী, পর্তুগীজ) ছাড়াও ঘরের শত্রুদের (কয়েকটি নাম হিসাবে যেমন জাট, শিখ এবং সাতনামি) সাথে পাল্লা দিতে হয়ত তিনিও আওরঙ্গজেবের মতই হতেন এবং দৃশ্যত তখন এসব হয়ে যেত যৌক্তিক এবং বৈধ। তাই বাড়ন্ত অর্থনীতি, সাম্রাজ্যের প্রসার এবং অন্তর্কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করা ছিল আওরঙ্গজেবের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। তিনি ধর্মীয় আবেগকে সামনে রেখেই ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু সাম্রাজ্য চালানোর ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে এই আবেগ তার কোন কাজে আসেনি।
একজন শাসকের মহত্ত্ব প্রকাশ পায় ক্ষমতায় শীর্ষে থাকা অবস্থায় তার অভাবনীয় দয়া আর বিরাট বিনয় দ্বারা। ফলে যখনই আকবর তার ক্ষমতার পথের কাঁটাগুলোকে সরিয়ে সাম্রাজ্যের ব্যাপারে শক্তিশালী-স্থির অবস্থানে আসতে পারলেন, তখনই সেখানে সুলহী-কুলের আলাপ তুললেন, মানে সকলের সাথে শান্তির প্রস্তাব। তিনি তখন বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের যেমন রাজপুত, শিয়া, পার্সী, জৈন এবং খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে উদারতা প্রকাশ করলেন। এছাড়াও তিনি তাদের বৈচিত্রপূর্ন নীতি-চর্চা থেকে অনেক কিছু সামনে আনলেন। একজন শাসককে আরো চেনা যায় তার সঙ্গীসাথী দিয়ে। আকবরকে আরো চেনা যাবে তার নবরত্ন দিয়েঃ যারা ছিলেন কাজে এবং জ্ঞানের সমাহার যেমন পন্ডিত আব্দুর রহিম খানই খানান, কর প্রশাসক তোডারমাল, ঐতিহাসিক আবুল ফজল, টেকনোক্র্যাট ফতেহউল্লাহ শিরাজী, বিশ্বস্ত সঙ্গী মান সিং, সঙ্গীতের তানসেন, কবি সুরদাস এবং রাজসভার ভাঁড় বীরবল। পাশাপাশি, বিখ্যাত রামভক্ত তুলসিদাস আকবরের আমলেই নতুন করে লেখেন হিন্দু ধারার “রামচরিত্রমানস”। এছাড়াও আব্দুল কাদির বাদাউনি নামের একজন কট্টর মুসলিম পন্ডিতকেও একরকম বাধ্য করে রামায়ন এবং মহাভারতের ফার্সি অনুবাদ করান আকবর।
সত্যি যে রাজনীতিতে সকল ধর্মকে সম্পৃক্ত করার প্রশ্নে আকবর অন্যদের চেয়ে আলাদা। আওরঙ্গজেব অন্যদিকে নিতান্ত সুন্নি ধারার মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা দ্বারা তার নেওয়া পদক্ষেপগুলোর ব্যাখ্যা করতেন। যার পরিপেক্ষিতে তিনি দ্বিতীয়বারে ব্যর্থ হলে সেটি পরবর্তীতে ইসলামের জন্যেও বদনাম বয়ে আনে। যদিও তার মন্ত্রীদের মধ্যেও একধরণের বৈচিত্র্য পাওয়া যায় যেমন সেখানে সংখ্যায় অনেক রাজপুত, মারাঠি এবং অন্যান্য ভারতীয় মানসব্দার গুরুত্বপূর্ন নানা পদে আসীন ছিল। তবুও জিজিয়া কর আরোপ করার বাড়াবাড়ি এবং রেটরিকাল নানা ঘোষণা তাকে একজন গোঁড়া শাসক হিসাবে চিত্রায়িত করেছে যেখানে তিনি আবার ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়াও আকবরের নবরত্নের বদলে আওরঙ্গজেবের আশেপাশে থাকত সুন্নী ধর্মতাত্ত্বিকরা যাদেরকে অবশ্য তার কিছুটা নাপছন্দ ছিল। আসলে ধর্মতাড়িত আদর্শ এবং অপরিণত প্রপাগান্ডার বদলে তার দরকার ছিল বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্য অথবা সকলের জন্যে উন্মুক্ত-সর্বব্যাপী কোন রাজনৈতিক চিন্তা। আকবরের মডেলটাই হয়ত অনুসরণ করা যেত যেটি আকবরের পরবর্তী শাসক এবং সন্তান জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) বুদ্ধিমত্তার সাথে গ্রহণ করেছিল। সাধারণ চিন্তা থেকে বলা যায়, সম্রাট শাহজাহানের (১৬২৭-১৬৫৮) পুত্র এবং সম্ভাব্য-উত্তরাধিকারী দারাশিকোহ নিজেও হয়ত ক্ষমতা পেলে সমাজের সর্বত্র এরকম সর্বব্যাপী শাসন চালিয়ে যেতেন যেখানে নানামতের যারা রাজনীতিতে সক্রিয় তাদের সকলের কাছ থেকে সমান দূরত্বে অবস্থান করতেন তিনি এবং কাউকে নিয়ন্ত্রনের সুযোগ দিতেন না।
আমাদের সময়ের শাসকরাও তাদের অনুসরণ করতে পারে: ক্ষমতায় থাকতে ধর্মকে ব্যবহার করা বা সমাজের সর্বত্র নৈরাজ্য তৈরি করা থেকে বিরত থাকা; অথবা, আইন ও আদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমাজের বৈচিত্র্যকে সুযোগ ও সম্মান দেওয়া এবং যাতে আইন ও বিচারিক ব্যবস্থায় যাতে কেউ ধর্মের ভিত্তিতে বেইনসাফের শিকার না হয়।
Comments
Post a Comment