ইসলামি রেওয়াজে গো-মাংসের ইতিহাসঃ
লেখক: রজীউদ্দীন অকীল
অনুবাদক: মিনহাজ আমান
নিরামিষভোজ-বাদ বর্তমানে একটি উগ্র রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যাকে লাইসেন্স দিচ্ছে। গো-হত্যার মত বিতর্কিত ঐতিহাসিক ইস্যুকে সামনে এনে জনসাধারণের উত্তেজনাকে ব্যবহার করে কিছু রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা চলছে এখানে। তবে মুসলিমদের জন্যে কিছুটা সহজ ব্যাপার হচ্ছে যে, গো-মাংস খাওয়া ইসলামের কোন মৌলিক ভিত্তি নয়। ইসলামে বিরাজমান নিজস্ব মতবিরোধকে আলাদা রেখে বলা যায়, ইসলামের মূল ভিত্তি মূলত এক আল্লাহতে বিশ্বাস, মোহাম্মদকে শেষ নবী (যেখানে তার পূর্ববর্তী নবী হিসাবে আছেন যিশূ, মুসা এবং দূরবর্তী অতীতে আছেন ইবরাহীম) এবং শেষদিনের বিচারে বিশ্বাস যেদিন ধর্মভীরু আর পাপীদের বেহেশত-দোজখ নির্ধারিত হবে। এক্ষেত্রে খোদার পথে চলবার সবচেয়ে সহজ রাস্তা হচ্ছে, নামাজ আদায় করা, হিজরির রমজান মাসে রোজা রাখা, জাকাত(ট্যাক্স) এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছলদের জন্যে মক্কায় হজ্ব করা। এছাড়া এসবের বাইরে কিছু হালাল(বৈধ) আর হারাম(নিষিদ্ধ) ব্যাপার আছে। সে হিসেবে মুসলিমদের জন্যে গো-মাংস খাওয়া হালাল আবার হারাম হচ্ছে শুকরের মাংস।
মধ্যযুগ থেকেই সস্তা এবং সহজপ্রাপ্যতার দরুণ ভারতের মুসলিমদের নিত্যদিনকার খাবারের তালিকায় গো-মাংস থাকে। তখন থেকেই অমুসলিমরা বিশেষ করে উত্তর ভারতের যা কিনা গরুর জন্যে প্রসিদ্ধ অঞ্চল, সেখানে নিরামিষভোজীদের এক নয়া উত্তেজনায় গো মাংসের ব্যাপারে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। তবে অনেক মুসলিম সুফীই সাধারণ মুসলিমদের এই খাবার-সংক্রান্ত সংকট বুঝতে পারে গো-মাংসের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছেন। বাঙলার সিলেটে প্রাপ্ত একটি সুফীবাদী ঐতিহাসিক পূথি থেকে গবেষক অনুরাধা ছন্দা দেখিয়েছেন, মুসলিমদের জন্যে গো-মাংস কোন বাধ্যতামূলক ব্যাপার না (গরু খাওয়া মুসলমানি নয়)। এর আগে, একেশ্বরবাদী সন্ত কবির মুসলিমদের এমন সকালে রোজা রাখা আর রাতে গো-মাংস খাওয়াকে সমালোচনা করেছিলেন।
যাই হোক, মোগল সময়ের একজন নকশেবন্দী নেতা শেখ আহমেদ সারহিন্দী বিতর্কিত এক ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ভারতে ইসলামের সবচেয়ে বড় সেবা হচ্ছে গরু জবেহ দেওয়া। সেমতই তিনি বাদশা জাহাঙ্গীরকে আকবরের উদার শাসনব্যবস্থা বাদ দেওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত মোঘলরা উদার এবং প্রগতিশীল মুসলিম হিসেবে এই বিষয়ে কিছুটা সতর্ক ছিলেন বিধায় তারা সিদ্ধান্ত দেন যে অধিকাংশ অমুসলিম যেহেতু গরুকে মা হিসেবে পূজা করে তাই গো-মাংস পরিহার করাই শ্রেয়।
আকবরের বিখ্যাত ইবাদতখানায় যেখানে কিনা সকল ধরণের ধর্মীয় ইস্যুর ব্যাপারে আলাপের স্বাধীনতা ছিল, সেখানে রাজসভার একজন ভাঁড় প্রশ্ন তুলেন যে মুসলিমরা গো-হত্যা করে অপরাধ করছে। কেননা, আল্লাহ নিজে গরু পছন্দ করেন বলেই কুরআনের প্রথম অধ্যায় যেখানে ইসলামের অনেক মূলনীতির আলোচনা হয়েছে সেই অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন “গরু” যার আরবি বাক্বারা। মোল্লা আব্দুল কাদির বাদাউনি একজন স্বকীয় ইসলামের সুরক্ষাকারী হিসেবে সেই সভায় লোকটির যুক্তিকে নিছক আহাম্মকি হিসেবে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কারণ খোদ কুরআনেই গরু জবেহ এর ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ আছে। সেখানে মুসা নবীর একটি ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায়।
মূলত কুরআন বলছে, ইসরায়েলীরা মুসা নবীর আল্লাহকে উপাসনার ডাকে তখন সাড়া দিচ্ছিল না এমনকি তাদের কেউ কেউ বাছুরকে পূজা করা শুরু করল। ফলে মুসা নবী ঘটনাচক্রে তার অনুসারীদের বললেন, আল্লাহর আদেশে তোমরা গরু জবেহ করো। তারা ক্ষেপে উঠলো এবং তারা নানা আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠল যা এখঙ্কার সময়ে আমাদের কাছে অনেকটাই আগ্রহোদ্দীপক। মুসার অনুসারিরা মুসাকে বলল, আপনি হয়ত আমাদের সাথে মশকরা করছেন। মূসা জোর দিয়ে বলেন, আমি যদি কোন কিছু দায়িত্বহীন কথা বলি, তাহলে আমি খোদার আশ্রয় প্রার্থণা করি। তারপর সবাই মিলে মূসাকে অনুরোধ করল যেন তিনি তার খোদাকে জিজ্ঞেস করেন জবেহ করার জন্যে কেমন গরু প্রয়োজন। উত্তর আসলোঃ গরুটি বয়স্ক বা একেবারে বাচ্চা হওয়া যাবেনা এবং যা আদেশ হয়েছে তা করো।
সেই কথামত কাজ না করে অনুসারীরা আবার মুসাকে আবার প্রশ্ন করল সে গরুর রঙ কী হবে। সেক্ষেত্রে এই উত্তরটির বিষয়ে আমাদের আধুনিক কালের হিন্দুত্ববাদীতার প্রধানতম যোদ্ধাদের নজরে রাখা উচিত। মনে রাখার ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনাটি বাইবেলের একটি ঘটনা যা ৮ম শতকের কোরআন থেকে নেওয়া, সেক্ষেত্রে আমাদের এই প্রেক্ষাপটটি আমলে রাখতে হবে। সেখানেও উত্তরে খোদা বললেন, গরুটি গাড় জাফরান রঙের হলে ভাল যেটি দেখলেই সবার পছন্দ হয়। তারপরেও এই উত্তর মুসার অনুসারীদের মনঃপূত না হওয়ায় খোদা আবার বললেন, এমন গরু জবেহ করো যা চাষবাসে ব্যবহৃত হয়না এবং সেই গরুগুলোতে যেন কোন ধরনের খুঁত পাওয়া না যায়। অবশেষে, তারা সবকিছু সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা পাওয়াও তারা মুসাকে খোদার নবী হিসেবে মেনে নেয় যদিও সেটা অনিশ্চিত ছিল তারা কী আসলেই খোদার কথা শুনবে কীনা!
Comments
Post a Comment